বাংলাদেশের মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থন : পথ পরিক্রমা

Bangladesh became the 116th nation in the world to sign this agreement to improve the access to books and reading for the country's people with disabilities.
Marrakesh Treaty- Accession-Bangladesh joins the Marrakesh Treaty to facilitate people with disabilities- Bangladesh- MJF-VIPS

২০১৮ এর জুলাইয়ের এক তপ্তমাখা দুপুর। বহু পুরোনো দুর্বল একটি সিলিং ফ্যানের নিচে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রারের চেয়ারে বসে ঘর্মাক্ত কলেবরে বসে আছি। ঠিক এ সময়ে Visually Impaired People’s Society (VIPS) এর পক্ষ থেকে ভাস্কর ভট্টাচার্য এক সঙ্গীসহ আমার সম্মুখের দুটি চেয়ারে বসলেন। পরিচয় ও খানিকটা আলাপচারিতার পর তিনি জানালেন, তার আসার উদ্দেশ্য – বাংলাদেশ সরকারের মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থন। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কপিরাইট আইন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। কারণ প্রতি বছর বিশ্বে লক্ষ লক্ষ বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই বইগুলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন উপযোগী করে লেখক বা প্রকাশকগণ মুদ্রণ করেন না। অন্যদিকে কপিরাইট আইন অনুযায়ী তাদের অনুমতি ছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন উপযোগী ব্রেইল বা মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রকাশ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফলে শিক্ষিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধীগণ বই পাঠের মাধ্যমে জ্ঞান চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের এ প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে World Intellectual Property Organization (WIPO) এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ২০১৩ সালের ২৭ জুন মরক্কোর মারাকেশ শহরে এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পাঠের অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যে মারাকেশ ট্রিটি স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে বিশ্বের ৫৪ টি দেশ এ ট্রিটি অনুসমর্থন করলেও বাংলাদেশ সরকার অদ্যাবধি চুক্তিটি স্বাক্ষর করেনি। ফলে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীগণ দেশ-বিদেশের অসাধারণ সৃজনশীল সাহিত্য পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি কোনো মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভিজুয়ালী ইম্পেয়ার্ড পিপল্‌স সোসাইটি (ভিপস) হতে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে যাতে করে চুক্তিটি দ্রুত অনুসমর্থন করা যায়।

তিনি আরও জানালেন যে মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং বিধিমালা, ২০১৫ এর আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় মারাকেশ ট্রিটি স্বাক্ষরের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তখন আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস কপিরাইট আইন নিয়ে কাজ করে। তাই এ আইন সংশোধনের জন্য কপিরাইট অফিসই কাজ করবে। এছাড়া আইপি অফিস হিসেবে কপিরাইট অফিসের ওয়াইপোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে। তাই ওয়াইপোর যে কোনো ট্রিটি অনুসমর্থনের ক্ষেত্রে কপিরাইট অফিস কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তিনি আমাকে মারাকাশ ট্রিটির একটি ফটোকপি দিলেন। পরবর্তী কয়েকদিন ধরে আমি গভীর মনোযোগ সহকারে ট্রিটিটি পড়লাম। একজন অভিজ্ঞ মেধাসম্পদ ল’ইয়ারের সঙ্গে ট্রিটির গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম। বুঝতে পারলাম, চুক্তিটির কয়েকটি ধারা কপিরাইট আইন এবং একটি ধারা এনবিআর-এর কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ফলে এ ট্রিটি অনুসমর্থন করতে হলে কপিরাইট আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন এবং এনবিআরকে নতুন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সময়ব্যাপী একটি জটিল ও দুরূহ প্রক্রিয়া। বিষয়টি ভাস্করকে জানালে তিনি বললেন যে কপিরাইট আইন সংশোধন ছাড়াও মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থন করার বিষয়ে ওয়াইপোর একটি গাইড লাইন আছে। তিনি আমাকে গাইড লাইনটি পাঠালে দেখতে পেলাম যে কপিরাইট আইন সংশোধনের পূর্বে মারাকেশ ট্রিটিতে প্রবেশের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে চুক্তটি অনুসমর্থন করা যায়।
যাহোক, চুক্তিটির প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদ গভীর মনোযোগসহ পুনরায় একাধিকবার পাঠ করলাম। এতে মোট ২২ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। তন্মধ্যে ৪নং ধারা কপিরাইট আইন সংশোধনের সঙ্গে জড়িত এবং ৫ ও ৬ নং ধারা কপিরাইট আইন ও এনবিআর উভয়ের বিধি ও প্র্যাক্টিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চুক্তির ৪নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চুক্তি সম্পাদনকারী কর্তৃপক্ষ কপিরাইট স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ব্যতিরেকে অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কেবল দৃষ্টি ও পঠন প্রতিবন্ধীদের অ্যাকসেসিবল ফরমেটে স্বত্ব বিদ্যমান। এধরনের কর্ম পুনরুৎপাদন, ডিজিটাল ফরম্যাটসহ যে কোনো পন্থায় উৎপাদন ও বিতরণের সুযোগ নিজেদের কপিরাইট আইনে অন্তর্ভুক্ত করবে। ৫ নং অনুচ্ছেদে “বিভিন্ন দেশের অনুমোদিত কর্তৃপক্ষসমূহ জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অ্যাকসেসিবল ফরম্যাট বিতরণ করতে পারবে” মর্মে উল্লেখ আছে। অবার ৬ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ মূল কপিরাইট প্রণেতার অনুমোদন ব্যতীত অ্যাকসেসিবল ফরম্যাটে প্রস্তুতকৃত উপকরণ আমদানি করতে পারবে। ফলে ৫ ও ৬ নং অনুচ্ছেদের সম্মতির ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন সংশোধন ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে উত্তোরণের উপায় সম্পর্কে পরামর্শ চাইলাম। কিন্তু কারো কাছেই সন্তোষজনক সমাধান পেলাম না। খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লাম। কেননা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এ ধরনের অনুমোদন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি – অত্যন্ত জটিল, সময় সাপেক্ষ ও প্রায় দুঃসাধ্য একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সহায়। জানা গেলো যে, রাজস্ব বোর্ডের এ সংশ্লিষ্ট বেশ পুরোনো একটি প্রজ্ঞাপন আছে। অনেক খোঁজ করেও এর কোনো কপি পাচ্ছিলাম না। বহু অনুসন্ধানপূর্বক ভাস্কর এর একটি কপি সংগ্রহ করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। ১৯৬৯ কাস্টমস আইনের ১৯ ধারা এবং ১৯৯১ সনের মূল্য সংযোজন আইনের ৯৪ (১) ধারার ক্ষমতাবলে জারিকৃত উক্ত প্রজ্ঞাপনে, কোনো দাতব্য ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো দাতা সংস্থা হতে অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত বা ক্রয়কৃত ও বাংলাদেশে আমদানিকৃত মূক, বধির, অন্ধ এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য অত্যাবশ্যক যন্ত্রপাতি ও উপকরণের উপর আরোপণীয় শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর মওকুফ আদেশ জারির কথা উল্লেখ রয়েছে। মূল বাধা অতিক্রমের উপায় খুঁজে পাওয়ায় তুমুল উৎসাহে ট্রিটির সংশ্লিষ্ট ৪, ৫ ও ৬ নং অনুচ্ছেদ ৩টি দ্রুত বাংলায় অনুবাদ করে এবং খুব সহজবোধ্যভাবে একটি সার-সংক্ষেপ তৈরি করে মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থন করার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সনের ১৯ জুন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে পাঠালাম। সারসংক্ষেপটি এতটা বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ স্বয়ং-সম্পূর্ণ ছিল যে, সচিব ও মাননীয় মন্ত্রীর স্বাক্ষর করে মন্ত্রিসভায় প্রেরণ ছাড়া বস্তুতপক্ষে মন্ত্রণালয়ের আর কোনো বিশেষ কিছু করার ছিল না।
প্রস্তাবটি বেশ কিছু দিন মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকায় সচিব মহোদয়ের শরণাপন্ন হলাম। তিনি প্রস্তাবটি পর্যালোচনার জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটা কমিটি করে দিলেন। অনেক অনুরোধের পর অতিরিক্ত সচিব সভা ডাকলেন। সভায় তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে এটি একটি মানবিক চুক্তি। এতে অনুসমর্থন করলে দেশের মানবিক আচরণের প্রকাশ ঘটবে এবং দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু একজন প্রভাবশালী সদস্য প্রবল যুক্তি দিয়ে বলে উঠলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি বিধায় চুক্তিটির অনুসমর্থনের দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নয়। আমি যতই বলার চেষ্টা করলাম যে ট্রিটিটি কপিরাইট আইন সংশ্লিষ্ট এবং আমাদের দেশে কপিরাইট অফিস সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এটি অনুসমর্থনের উদ্যোগ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও প্রস্তাবটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো। দিন যায়, মাস যায়, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। চলে গেলো ২০১৯ সাল। এলো নতুন বছর ২০২০ সাল। ভিপস এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) যৌথভাবে এফসিডিও এর অর্থায়নে “Strengthening Government Primary Education for Equal Rights of Learners and Teachers with Disabilities “ প্রকল্পের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থনের জন্য কপিরাইট অফিসে, মাঝে মাঝে চুক্তিটির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চান। কিন্তু কোনো সদুত্তর দিতে পারি না। এর মাঝে এপ্রিলে নতুন সচিব এলেন। আমি মারাকেশ চুক্তিটি সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলাম। বললাম যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পাঠের সুযোগ ছাড়া এ চুক্তির সঙ্গে কোনো আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের দূরতম সম্পর্কও নেই। ফলে তিনি আদেশ দিলেন এ সম্পর্কিত নথি উপস্থাপনের। পুনরায় গঠিত হলো একটি কমিটি। এবারে কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হলো আইন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি প্রোগ্রামে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা থাকায় এ কমিটির চূড়ান্ত সভায় আমি থাকতে পারলাম না। দুর্ভাগ্যবশত কমিটির সভায় নেয়া হলো ভয়ানক সিদ্ধান্ত : মারাকেশ ট্রিটির ৪, ৫ ও ৬ অনুচ্ছেদ কপিরাইট আইনের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হওয়ায় কপিরাইট আইন সংশোধন হওয়ার পর চুক্তিটি অনুস্বাক্ষর করা সমীচীন হবে। এ সিদ্ধান্তে আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে কেটে গেলো আরও অর্ধ বছর। এলো নতুন বছর ২০২১ সাল। খুশির খবর, মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব এসেছেন। আমার ব্যাচমেট আবুল মনসুর। তাকে একান্তে মারাকেশ ট্রিটির গুরুত্ব ও এর মানবিক দিক বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বললাম। তিনি ডেস্ক অফিসারকে ডেকে দ্রুত এ সংক্রান্ত নথি উপস্থাপনের নির্দেশ দিলেন। যেহেতু এ বিষয়ে পূর্বের একটি কমিটির সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করতে হবে, তাই অতিরিক্ত সচিব মিস সাবিহা পারভীন এর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দিলেন। সাবিহা আমার ব্যাচমেট, তার সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারণা, যথেষ্ট বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি খুব দ্রুত সভা আহ্বান করলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত মারাকেশ ট্রিটিতে যোগদান করলে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। অতএব, এটি অনুমোদনের জন্য দ্রুত কেবিনেটে পাঠানো হোক। তবে আন্তর্জাতিক চুক্তি বিধায় এ বিষয়ে পররাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ সংগত হবে। ২০২১ সাল প্রায় শেষের দিকে। আমি ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছি। কারণ ২০২২ সালের ৪ মার্চ আমি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাবো। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বারংবার যোগাযোগের ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত দ্রুত পাওয়া গেল। এবার আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং। সচিব মহোদয়ের ব্যক্তিগত অনুরোধে আমার অবসর গ্রহণের দিন কয়েক আগে আইন মন্ত্রণালয়ের কাঙ্ক্ষিত মতামত পাওয়া গেলো। অবশেষে ১১ মে ২০২২ তারিখে অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি কেবিনেটে পাঠানো হলে তা অনুমোদিত হয়। অতঃপর বাংলাদেশ সরকারের মারাকেশ ট্রিটিতে অংশগ্রহণের সম্মতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হলে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৬তম দেশ হিসেবে মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থন করার মর্যাদা লাভ করে। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় একটি মহৎ ও মানবিক উদ্যোগের কার্যক্রম অবশেষে সফলভাবে সমাপ্ত হলো। বলাবাহুল্য যে, আমার তিন দশকেরও অধিক সময়ের সুদীর্ঘ সরকারি কর্মজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে – দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পাঠের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থনের সফল বাস্তবায়ন।
এখন দেখা যাক মারাকেশ ট্রিটি অনুসমর্থনের ফলে কি পাওয়া গেলো –
প্রথমত: দেশে বিদেশে প্রকাশিত যে কোনো জননন্দিত লেখকের যে কোনো বই লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন উপযোগী উপায় যেমন – ব্রেইল, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক ভার্সন বা মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকে রূপান্তর করা যাবে। তবে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে অবশ্যই কেবল দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এ মুদ্রণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন উপযোগী ব্রেইল বা মাল্টিমিডিয়া টকিং বই বা অডিও বুক ও অনুরূপ উপকরণ বাংলাদেশে সহজে আমদানি করা যাবে। ফলে কেবল দেশের নয়, বিদেশি উন্নত মানসম্পন্ন বইগুলোও এদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের পাঠ করার সুযোগ সৃষ্টি হলো।
তৃতীয়ত: অনুরূপভাবে বাংলাদেশে প্রকাশিত মানসম্পন্ন বইগুলোও অন্যান্য দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো।
চতুর্থত: মারাকেশ ট্রিটির অনুসমর্থন করায় সদস্য হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ ওয়াইপোর অধীন Accessible Books Consortium ( ABC) নামক একটি বেসরকারি সংস্থার প্রায় ৪ লক্ষ বই পাঠের সুযোগ পাবেন।
পঞ্চমত: সর্বোপরি এ দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষে জন্য বই পাঠের নির্মল আনন্দের মাধ্যমে আপন হৃদয়কে কলুষতা মুক্ত করার এক অনিন্দ্য ও অপরিসীম সুযোগ তৈরি হলো।
মারাকাশ ট্রিটিতো অনুসমর্থন করা হলো। এখন আমদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। আমার মতে, নিন্মবর্ণিত কাজগুলো সম্পন্ন না হলে আমরা মারাকেশ ট্রিটির সম্পূর্ণ সুফল কখনও ভোগ করতে পারবো না।
প্রথমত: নতুন কপিরাইট আইনের যথাশীঘ্র অনুমোদন।
দ্বিতীয়ত: এদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণ করার আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি করা। যেমন : শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন।
তৃতীয়ত: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্য থেকে দক্ষ শিক্ষক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ।
চতুর্থত: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত বই বাছাই এবং পঠন উপযোগী করে প্রকাশ করার লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী ও উপযুক্ত কমিটি গঠন।
পঞ্চমত: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন উপযোগী করে বই প্রকাশে সহায়তা করার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন।
ষষ্ঠত: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে বই পাঠ ও শ্রবণকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রমোশনাল কার্যক্রম গ্রহণ।
সপ্তমত : দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন উপযোগী বই আমদানি ও মুদ্রণের লক্ষ্যে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন বা প্রতিষ্ঠা।
অষ্টমত: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পাঠের জন্য সহায়ক প্রযুক্তিসমূহ তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
– জাফর রাজা চৌধুরী, সাবেক রেজিস্ট্রার, কপিরাইটস, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস

Leave a Comment